সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫ দিনপর অফিস কক্ষে ফিরলেন চিকিৎসকরা


(ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে : দুই দাবীতে সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইউএইচও ও চিকিৎসকদের
মধ্যে চলছিল নীরব দ্বন্ধ। চিকিৎসকদের অফিস কক্ষের ফটকে ঝুলছিল তালা। তারা জরুরী বিভাগে বসে গল্প গুজব করে ও ঘুরে ফিরে সময় পার করছিলেন। আবার প্রেষণে ও মাতৃত্ব ছুটিতে রয়েছেন ৮ চিকিৎসক। সপ্তাহে মাত্র ২-৩ দিন অফিস করে হাজিরা খাতায় পুরো সপ্তাহের স্বাক্ষর করার অভিযোগও রয়েছে ২/৩ জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। ফলে হাসপাতালে বিরাজ করছিল অচলাবস্থা। একজন চাকমো অবসরে যাওয়ায় হাসপাতালের জরুরী বিভাগে দায়িত্ব পালন নিয়ে এমন ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানায়। এ বিষয়ে ইউএইচও ও চিকিৎসকদের বক্তব্য পরস্পর বিরোধী। অবশেষে ৫ দিনপর অফিস কক্ষে ফিরেছেন চিকিৎসকরা। গতকাল মঙ্গলবার থেকে তারা স্ব-স্ব কক্ষে বসে রোগী দেখা শুরু করেছেন। স্বস্থি ফিরে এসেছে স্থানীয় রোগীদের মধ্যে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ৫০ শয্যা সরাইল হাসপাতালে মোট চিকিৎসক ২০ জন। কিন্তু কর্মরত আছেন ১২ জন। সরকারি নিয়মে সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অফিস সময় মানছেন না এখানের চিকিৎসকরা। সকাল ৯ টা বা ১০টার আগে কেউ দফতরে আসেন না। আবার ১টার আগেই চলে যান।
সম্প্রতি জরুরী বিভাগের ডিউটিতে সহায়ক ব্যক্তি ও সপ্তাহে ২-৩ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিতির সুযোগ চান ২-৩ জন চিকিৎসক। এমন প্রস্তাবে সম্মত হননি ইউএইচও। শুরু হয়ে যায় ইউএইচও’র সাথে চিকিৎসকদের নীরব দ্ধন্ধ। গত ২৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চিকিৎসকদের অফিস কক্ষে ঝুলছে তালা। সেখানে বসে রোগী দেখা বন্ধ করে দেন। গিজাগিজি করে এমএলএসএস’র টেবিল দখল করে বেশ কয়েকজন বসে থাকেন জরুরী বিভাগে। আর বাকীরা আশেপাশে ঘুরে গল্প গুজব করেই সময় পার করছেন। আর ওদিকে রোগীরা এসে ঘুরছে। তালা দেখে অনেকেই চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার হ্যাঁ হুতাশও করছেন। গত সোমবার সকাল ১১টায় হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় ৩-৪ জন চিকিৎসক জরুরী বিভাগের ছোট কক্ষটিতে বসে আছেন। আর কয়েকজন চিকিৎসক আশপাশে ঘুরছেন। মূল ভবনে ঘুরছে মহিলা ও পুরুষ রোগীরা। ইউএইচও’র কক্ষের সামনেও দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কিছু রোগী। চিকিৎসকদের ২/১ টি কক্ষে বসে রোগী দেখছেন উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোঃ শহিদ উল্লাহ সহ দুইজন। শহিদুল্লাহ জানান, আমি একাই অর্ধশতাধিক রোগী দেখেছি। আমার সহকর্মী দেখেছেন শতাধিক রোগী। দুপুর সোয়া ১টায় গিয়ে দেখা যায়, সকল চিকিৎসকের কক্ষেই ঝুলছে তালা। জরুরী বিভাগে বসে আছেন ডাঃ নাছির উদ্দিন। হাজিরা খাতায় ১০ জনের স্বাক্ষর থাকলেও আর কোন চিকিৎসক উপস্থিত নেই হাসপাতালে। কয়েকজন রোগী ঘুরছেন মূল ভবনে। আর কাউন্টারে বসে হিসাব কষছেন ২ ব্যক্তি। হাসপাতালের রেজিষ্ট্রার অনুসারে গতকাল চিকিৎসা নিয়েছে মোট ৩৬৪ জন রোগী। চিকিৎসকরা দেখেছেন মাত্র ১৪০ জন। বাকী ২২৪ জন রোগীর চিকিৎসা কে করেছেন? হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির লোকজন ঘুরছেন চারিদিকে। হাসপাতালে কর্মরত জনৈক কর্মচারি আক্ষেপ করে বলেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে হাসপাতালে যে আলামত শুরু হয়েছে।
 এমন তামাশা আমরা এখানে জীবনেও দেখিনি। ঠিক ২টার দিকে জরুরী বিভাগের ১টি চেয়ারে এসে বসেন ডাঃ কাজী সামসুল আরেফিন। তার পাশে এমএলএসএস’র ১টি গোলাকার আকৃতির টেবিলে বসেন ডাঃ এ এইচ এম মশিউর রহমান। ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ মোঃ নাছির উদ্দিনের কাছে হাসপাতালের অচলাবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে চাকমোরা জরুরী বিভাগে মেডিকেল অফিসারদের সহায়তা করতো। এখন তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একা রাত জেগে কাজ করা যায় না। জরুরী বিভাগে কষ্ট করে দায়িত্ব পালন করলেও কোন সেকরিপাইস পায় না। তাই যৌক্তিক দাবী আদায়ের প্রতিবাদ স্বরুপ চিকিৎসকরা তাদের অফিস কক্ষে না বসে জরুরী বিভাগে রোগী দেখছেন। আমাদেরকে সহায়ক চাকমো ও রাত জেগে দায়িত্ব পালনের সুবিধা দেয়ার দাবীতে এ অবস্থা চলছে। কবে পর্যন্ত চলবে? এমন প্রশ্নের উত্তর হেসে উড়িয়ে দেন ডাঃ নাছির উদ্দিন। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ হাসিনা আক্তার বেগম বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, জরুরী বিভাগে ডিউটি করলে তাদেরকে ২-৩ দিন অনুপস্থিত থাকার সুযোগ দিতে হবে। বিষয়টা নিয়ে মূলতঃ নতুন চিকিৎসকরা আন্দোলন করছে। বিনা কারনে তারা ২ দিনের ছুটি ভোগের সুবিধা চাচ্ছেন। আমি জেনে শুনে তো অনিয়মের সুযোগ দিতে পারি না। তাই চিকিৎসকরা গত বৃহস্পবিার থেকে অফিস কক্ষে বসছে না। রোগী দেখছেন না। জরুরী বিভাগে বসে সময় কাটাচ্ছেন। এখন রোগী দেখছে কে? এতে রোগীদের সমস্যা হচ্ছে কিনা? এমনসব প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন ২ জন চাকমো রোগী দেখছেন। আমি নিজেও দেখছি। সমস্যা তো কিছুটা হচ্ছেই। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। দেখি দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে।
প্রেষণে ৬ চিকিৎসকঃ
কর্মরত ১২ চিকিৎসকের মধ্যে ৬ জনই রয়েছেন প্রেষণে অন্য হাসপাতালে। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, পদ না ছেড়ে বেতন নিচ্ছেন সরাইল থেকে আর সেবা দিচ্ছেন অন্য জায়গায়। ফলে কর্তৃপক্ষ এখানে তাদের জায়গায় চিকিৎসক পদায়ন করতে পারছেন না। প্রেষণে থাকা চিকিৎসকরা সরাইলের ক্ষতি করছেন। প্রেষণে রয়েছেন জুনিয়র কন্সালটেন্ট (শৈলা) ডাঃ জুনাইদুর রহমান লিখন, জুনিয়র কন্সালটেন্ট (গাইনী) ডাঃ মাহফুজা আসমা, জুনিয়র কন্সালটেন্ট (শিশু) ডাঃ মোঃ জসিম উদ্দিন, মেডিকেল অফিসার ডাঃ আমেনা খায়ের লোপা, ডেন্টাল সার্জন ডাঃ নাফিছা আলম ও সহকারি সার্জন ডাঃ আয়েশা সিদ্দিকা। আর মাতৃত্ব ছুটিতে রয়েছেন মেডিকেল অফিসার ডাঃ শামীমা ইয়াসমীন ও ডাঃ তানজিনা আক্তার।
যে কারনে অচলাবস্থা হাসপাতালেঃ
উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ডাঃ বাবুল চন্দ সাহা দিনে রাতে দায়িত্ব পালন করতেন জরুরী বিভাগে। গত ৩০ আগষ্ট তিনি পিএল আর-এ চলে যান। তার পদটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপরই জরুরী বিভাগে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসকদের উপর কিছুটা চাপ পড়ে। কিন্তু এ চাপ সইতে নারাজ চিকিৎসকরা। তারা জরুরী বিভাগে দায়িত্ব পালন কালে সহায়ক হিসাবে চাকমোদের দেয়ার দাবী তুলেন। সেই সাথে জরুরী বিভাগে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসককে সপ্তাহে ২-৩ দিন অনুপস্থিতির সুযোগ দেয়ারও প্রস্তাব করেন ইউএইচও’র কাছে। চিকিৎসকদের এমন অযৌক্তিক ও বিধি বহির্ভূত দাবী প্রত্যাখ্যান করেন ইউএইচও। বেঁকে বসেন চিকিৎসকরা। তারা অফিস কক্ষে বসা ও রোগী দেখা বন্ধ করে দেন। ৪-৫ জন চিকিৎসক একসাথে জরুরী বিভাগে বসে সময় কাটান। অনেকে এসে স্বাক্ষর করে চলে যান। আবার কয়েকজন হাসপাতালের ভেতরই ঘুরাফেরা করে চলে যান। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের দিয়ে রোগী দেখান ইউএইচও।
 তিনি নিজেও দেখেন রোগী। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে গত সোমবার পর্যন্ত সরাইল হাসপাতালে চলে এ অচলাবস্থা। পরে সোমবার গভীর রাতে জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সভা বসে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ হাসিনা আক্তার বেগম ও সকল চিকিৎসকরা। পরে জরুরী বিভাগে চিকিৎসকদের সাথে সহায়ক হিসাবে চাকমোদের দেয়ার শর্তে নিস্পত্তি হয়। কিন্তু অনুপস্থিত থেকে স্বাক্ষর দেয়ার দাবী মানা হয়নি। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সরজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন রোগী ঘুরছেন। প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন ৫-৬ জন ঔষধ কোম্পানির এম আর। কোন চিকিৎসক আসেননি। সাড়ে ৯টার দিকে একসাথে আসেন ২-৩ জন চিকিৎসক। তারা বলেন, আমাদের বিষয়টি গত রাতে জেলায় বসে নিস্পত্তি করা হয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

দেশে আপওয়ার্ক বন্ধ নিয়ে বিতর্ক

সরাইলে শুরু হয়েছে দুদিনব্যাপী ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী কালীকচ্ছ সম্মিলনী’